ডানাহীন পাখি
ডানাহীন পাখি |
আমার কাছে বিয়ে অনেক মজার একটা বিষয় ছিলো।
বুঝতামই বা কতটুকু।
মাত্রতো হাইস্কুলের গন্ডি পার করবো বলে।
বিয়ে শুনে একটু লজ্জা, একটু ভয়, আবার একটু স্বপ্ন,
বিয়ে হবে, একটা ছেলে অনেক যত্ন নিবে, সাথে নিয়ে ঘুরবে,
আরো কত কি!!!
৫ টি দিনও লাগেনি বুঝতে যেমনটি ভেবেছি বাস্তবতা মোটেও তেমনটা নয়।
বিষয়টা অনেক কঠিন আর গাম্ভীর্যপূর্ণ।
আরো কিছুদিন যেতেই বুঝলাম কেউ যত্ন নিবে না।
আমার শরীরটা ব্যথা করে,
তাতে কারো কিছুই আসে যায়না।
রক্ত দেখলে ভীষণ ভয় হতো, এভাবে কেউ রক্তাক্ত করে দিবে স্বপ্নেও ভাবিনি।
কাকে বলবো?
মা তো বলে ওসব কিছুনা মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আজ অনেক অনেক বছর পর মাকে জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে করে,
কি ঠিক হবে মা আমাকে একটু বলতে পার?
একটি পশু প্রতিরাতে ছিড়ে খায় আমার মাংস,
সেই যে শুরু আজও চলছে মা।
তাকে ওই ৫-১০ মিনিটই পাশে পাই মা।
এখনতো বুঝি, বড় হয়েছি, অনেক বড় হয়েছি।
মা আমি এখন সত্যিই বুঝি আমি এই সমাজের একটা খেলনা।
আনন্দ দিয়ে যাবো আমার জিবনের মালিক,
মানে সেই পুরুষকে যে আমাকে দেনমহরে দলিল করে কিনে নিয়েছে।
এখন যেভাবে নাচাবে সেভাবে নাচবো।
নিজেকে ফুল ভাবতাম মা,
পরীদের রাজ্যে ছিলো বসবাস।
সপ্ন ছিলো এক রাজকুমার আসবে,
রুপকথার রাজকুমার নয়, সত্যিকারের রাজকুমার,
যে অনেক ভালোবাসবে।
চোখের কোনে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে তার ভালোবাসার আবেগে।
মুছে দিবে রাজকুমার অনেক যত্নে,
পরম আদরে ভরিয়ে দিবে মন, ভালোবেসে সকল যন্ত্রণা সমস্ত ক্ষত মুছে দিবে।
এখন চোখ থেকে অঝরে ঝরে জলকণা,
যখন মরার মত দেহ পড়ে থাকে কারো শরীরের নিচে,
চোখ থেকে পড়া জলধারা সে দেখেনা মা।
এক যুগ পেরিয়ে গেছে তার কামুক চোখে আমার যন্ত্রণা ধরা পড়েনি, আজও পড়েনি।
সন্ধেহ হয় সে আমার চেহারাটা চেনেতো মা?
কখনোতো গাল দুটো ছুঁয়ে দেয়নি,
হাত বুলায়নি চোখে, মুখে বা মাথায়।
চোখে চোখ রাখা হয়নি কোনদিন।
হাতটাও স্পর্শ করিনি কোনদিন। কখনো শুনিনি তার বুকে ধক ধক শব্দ হয় কিনা।
মা সে কি জানে আমার গলায় সুন্দর একটা তিল আছে?
চিবুকে থাকা তিলটা কতটা সুন্দর।
সে কি জানে কাজল দিলে আমার দুটি চোখের গভীরতা কতটা মায়াবী দেখায়।
জানালার গ্লাসে চোখ রেখে আকাশটা দেখা
আর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কল্পনায় ডুবে থাকাই আমার জীবন।
জানো মা, আমি ভুলে গেছি কবে হেসেছি।
আমি জানিনা বাতাসের গন্ধ কেমন হয়,
জানিনা পাখির কিচিরমিচির শব্দ কেমন হয়,
সেইতো কত কত বছর আগে এসে ঢুকেছি এই খাঁচায়,
আরতো বের হওয়া হয়ে ওঠেনি মা।
আমিতো কোন অপরাধ করিনি মা,
একটু ভালোবাসাইতো চেয়েছি।
এতটুকু চাওয়াতো অপরাধ নয়।
গহীন জংগলে বাঘের গর্জনে এতটা ভয় পেতাম কিনা জানিনা
যতটা তার গলার শব্দে পাই, যার হাতে তুলে দিয়েছিলে আমায়।
এই জন্যেই বুঝি তুলে দিয়েছো মা?
আমি কি বোঝা হয়ে গিয়েছিলামগো মা?
আমি কি পারতাম না স্বাধীন একটা পাখি হতে?
পারতাম না এই সুন্দর পৃথিবীটা উড়ে উড়ে দেখতে ওই নীল আকাশের বুকে।
বাদ দাও সেসব।
জানো মা, একটি ছেলে আছে।
একটু বোকা ছেলেটা।
আমাকে বলে ছাদে যান না কেন? আকাশে চাঁদ দেখতে ভালো লাগেনা আপনার?
কি বলবো বল মা, চাঁদ আবার দেখার জিনিষ হলো, বলো?
আবার বলে গান শুনবেন?
ভোর কেমন লাগে, জোছনা ভালোবাসেন, নাকি বৃষ্টি?
অনেক বোকা ছেলেটা।
এগুলোতে ভালোলাগার কি আছে।
সেদিন একটা বই দিয়ে বলে রবিন্দ্রনাথ ভালো লাগে নাকি নজরুল?
কি বলা যায় মা একটু শিখিয়ে দিবে? আমিতো জানিনা।
আজকাল আমি কেমন জানি হয়ে গেছি মা।
এক যুগ পর সেদিন একটু মন ভরে হাসলাম,
এই ছেলেটা একটা পাগল।
যোর করে ছাদে নিয়ে গেলো, বৃষ্টিতে ভেজালো।
খুব কেঁদেছি মা।
আনন্দে কেঁদেছি, এত ভালো যে গত এক যুগে কখনো অনুভব করিনি।
শিউরে উঠেছিলো ওর স্পর্শে আমার সারা শরীর।
আমার চোখের জল ও দেখেনি, বৃষ্টিতে মিলিয়ে গেছে পরম অনন্দের অশ্রুকণা।
পাগলটা এত পাগলামি করে আমাকে ভালো রাখতে,
আমি জানিনা কিভাবে বোঝে আমার মনের যন্ত্রণাগুলো।
বোবা কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়।
আজকাল মনেহয় আমি একটি জড় বস্তু নই,
আমার প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে।
মা, ওমা, বলনা আমি কি করবো?
আমি কি সমাজ নামের আড়ালে স্বৈরাচারীর কাছে হার মেনে
আবার মরে যাবো যেমন করে মরে গিয়েছিলাম এক যুগ আগে।
নাকি নতুন করে বাঁচবো,
যেমন বাঁচা শিখিয়েছে আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ পাগলটা,
আমারতো চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছিলো মা।
কত বছর হল কাঁদতেও পারিনা আমি। আজকালতো আবার চোখ ছল ছল হয়,
সারাটাদিন চোখ জলে ছল ছল করে মা, পরম সুখে, তৃপ্তিতে।
আমি কি হত্যা করবো এই সুখ,
এই নতুন পাওয়া জীবন,
ভদ্র সমাজের সুশীল ভালোমানুষগুলোর চোখে বাধ্য মেয়েটি হয়ে থাকতে।
কি অপরাধ আমার?
আমার জিবনে কি নিজের কোন চাওয়া নেই?
তোমাদের কাছেও পুতুলই ছিলাম তাই না মা?
তারপর তো কারো ঘরের শো-পিচ হলাম।
শোভা বর্ধন ছাড়া আর কি কাজ আমার বলো।
মা আমি গুনতে পারবো কতটা শব্দ বিনিময় হয়েছে তার আমার মাঝে এতটা বছরে।
একটা কথা বলবে মা?
বাবাও কি এমন?
আমি আসলে জানিনা মা, কেমন। সবাই কি এমন?
রাতে চড়াও হবে, শকুনের মত ছিঁড়ে খাবে,
দেখবেনা তুমি কি হাসছ না কাঁদছ। এটাই?
মা ওই পাগলটা এমন না।
ওর চোখে তা দেখিনি আমি যা দেখেছি আমার ওই মালিকের চোখে।
কত নির্মল সে তা কিভাবে বোঝাবো মা?
ওর চোখে তাকালে মনেহয় বিশুদ্ধ এক জোড়া চোখ, যাতে পাওয়া যাবে বিশ্বস্ত আশ্রয়।
নিঃশ্বাসের শব্দে যে বুঝে নিতে পারে কেমন আছো তুমি,
কি তোমার চাওয়া।
মা একটু বল তো আমি কি হারিয়ে যাবো আবার সে অন্ধকারে,
আবার কি মরে যাবো মা?
এ পাগল তো আমার কাছে কিছুই চায় না। আমি একটু হাসলেই ও খুশি মা।
ও মা, প্লিজ বল আমাকে আমি কি শরীরহীন এ মনের প্রেমেও কলঙ্কিনী হব?
হব মা হব, এ সমাজ আমার জন্য নয় মা।
এখানে জন্মটা অভিশাপ।
তার চেয়ে বড় অভিশাপ মা তোমার আর বাবার কোলে জন্মে।
চাইলেই কি পারতেনা ডানা মেলে উড়তে শেখাতে?
চাইলেই কি পারতে না মা বলো।
মা গো জানিনা কি হবে।
আবার মরে পড়ে থাকবো ওই খাঁচায়,
নাকি খুঁজে নেব সুখ ওই পাগলের মাঝে, আমি জানিনা মা।
ভালো থেকো মা।
হয়তো আমিও খুব শিঘ্রই আসছি তোমার কাছে।
নয়তো ডানা মেলে উড়ে বেড়াবো ওই নীল আকাশে।